শিয়াবে আবি তালিব ও আমাদের শিক্ষা।
এস এম জুলফিকার জুয়েল
অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও- সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়াতপ্রাপ্ত। -সূরা বাকারা, ১৫৫
আমরা কোনো কঠিন মূহুর্ত বা বিপদের সম্মুখীন হলে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ি। আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাগুলোর সময় আমরা ধৈর্য ধারণ করতে ব্যর্থ হই! মহানবী (স.) শিয়াবে আবু তালিবে ত্যাগ-তিতিক্ষার একটি অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
"শিয়াবে আবি তালিব" ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ সম্প্রদায় দ্বারা বনু হাশিম গোত্রকে বয়কট করা বুঝানো হয়। নবী (স.) এর নবুয়ত লাভের কিছুদিন পরই আমীর হামযা (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) এর মতো সম্মানিত ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে কুরাইশদের ক্রোধ, ক্ষোভ ও অভিমান প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। ফলে তারা মুসলমানদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে।
মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যা করার জন্য আত্নপক্ষ সমর্থন করতে বললে আবু তালিব এটাকে প্রত্যাখান করে। তখন কুরাইশ বংশ ও সকল বংশ একত্র হয়ে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের সাথে সকল লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
তাদের ধারণা ছিল মুত্তালিব ও হাশিম গোত্রের সহযোগিতাই মুহাম্মদ (স.) এর শক্তির উৎস। তাই তারা মুসলমানদেরকে এবং এ দুটি গোত্রকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন ও একঘরে করে রাখার উদ্দেশ্যে সকলে ঐকমত্য পোষণ করে। অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করে।
চুক্তিনামায় সাক্ষর করে তা কাবা শরিফের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। মুহাম্মদ (স.) কে হত্যা করার জন্য স্বেচ্ছায় কুরাইশদের কাছে সমর্পণ না করা পর্যন্ত এ চুক্তি জারী থাকবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। (এ চুক্তিনামার লেখক মনসুর ইবনে ইকরামার হাত পরবর্তীতে অকেজো হয়ে গিয়েছিল।)
এ সিদ্ধান্ত শুনে আবু তালিব ঘোষণা বলেন-
“এ মসজিদের মালিকের শপথ! আহমদকে আমরা কখনো তাদের হাতে অর্পণ করবো না! তার সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে কালনাগিনী দংশন করলেও নয়।”
মুহররম মাসের প্রথম চাঁদ রাতে আবু লাহাব বাদে
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চাচা আবু তালিব অপারগ বাড়ি ঘর ছেড়ে মুহাম্মাদ সহ বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের নারী,পুরুষ ও শিশুসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাধ্য হয়ে শিয়াবে আবু তালিব নামক পাহাড়ে মধ্যে আত্মনির্বাসিত হন।
চুক্তি অনুসারে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের সাথে বেচা- কেনা, বিয়ে শাদি, সাহায্য সহযোগিতা, সামাজিক লেন-দেন, কথাবার্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। শিয়াবে আবু তালিবে বন্দি ব্যক্তিদের কোনো ধরণের সাহায্য করলেও তার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কুরাইশদের এ হঠাৎ সিদ্ধান্তের ফলে শিয়াবে আবু তালিবে কোনো ধরণের খাদ্য-শস্য বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে প্রবেশের সুযোগ ছিল না। বরং তারা যার কাছে যা আছে শুধুমাত্র তা নিয়েই গিরি সংকটে প্রবেশ করেছিলেন।
অবরুদ্ধ জীবনে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠল। ক্ষুধা ও অর্ধাহারের বিষাক্ত ছোবল থেকে এ সময় কেউ রক্ষা পায়নি। এ সময় পানির অভাবে তারা অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়েছেন। বিভিন্ন রোগও ছড়িয়ে পড়েছিলো। বেশীরভাগ মানুষই মৃত্যূর প্রায়-দ্বার প্রান্তে এসে দাড়ালেও তাঁরা ধৈর্য ধারন করেন। তাঁদের মধ্যে একজনও পশ্চাদপদ হননি। ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে শিয়াবে আবু তালিবের বাইরে থেকেও ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে পড়া শিশু সন্তান ও মহিলাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যেত।
সাহাবীগণ তাদের অবস্থা সম্পর্কে বলেন,
“এ সময় আমরা গাছের পাতা সিদ্ধ করে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করতাম। পানির অভাবে ও বৃক্ষপত্র ভক্ষণের ফলে আমাদের মল ছাগলের মলের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল।”
শিয়াবে আবি তালেব এর জেল জীবন তিন বছর স্থায়ী হয়। তিন বছর পর কুরাইশদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা শিহাব ইবনে আমের ও আব্দুল মুত্তালিবের দৌহিত্র যুবায়ের, মোত'আম ইবনুল আদ্দি, আবুল বোখতারী, ইবনে হিশাম এবং যুম'আ ইবনুল আসওয়াদ
প্রমুখ মিলে সশস্ত্র হয়ে যোবায়েরের নেতৃত্বে উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে শিয়াবে আবু তালিব দূর্গে গমন করে রাসুল (সাঃ) সহ সকল বন্দীদের মুক্ত করে নিয়ে আসলেন।
যুগে যুগে আত্নঅহংকারী ধনী লোকেরাই অসহায় মানুষদের উপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে তাইতো শরৎচন্দ্রের পন্ডিতমশাই উপন্যাসের, বৃন্দাবনকে কুসুম বলেছিলেন- আমাদের মতো দীন-দুঃখীকে জব্দ করে, তোমার মতো বড়লোকের বাহাদুরি কি বাড়বে?