মোঃ শামীম হোসেন – খুলনা বিভাগীয় প্রতিনিধিঃ- অভাব-অনটন দূর হচ্ছে না সুন্দরবনের জেলেদের। সেই ছোটকাল থেকে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরতিছি। সত্তর বছরের বেশি বয়স হয়ে গেল, এখনো সেই মাছ ধরেই যাচ্ছি। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন দূর করতি পারলাম না! খায়ে, না খায়ে আমার জীবনডা কাইটা গেল! এহন ভাবছি ছাওয়ালগের কথা। আগের মতো সুন্দরবনে আর মাছও পাওয়া যায় না। আমার জীবন তো কাটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবে?’ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের সামনে শাকবাড়ীয়া নদীর পাড়ে ডিঙ্গি নৌকার ওপর বসে কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব জেলে হযরত আলী সানা হতাশার সুরে এসব কথাই বলছিলেন। শুধু হযরত আলীই নন, তার মতো সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অন্য জেলেদের সংসারের হালচালও প্রায় একই রকম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। কিন্তু আগে যেখানে একেক জন জেলে একটি পাশ পারমিট (বিএলসি) নিয়ে পুরো খুলনা রেঞ্জের প্রতিটি নদী-খালে মাছ ধরতে পারতেন, সেখানে এখন থেকে কোনো জেলে একটির বেশি খালে মাছ ধরতে পারবেন না। এতে চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার জেলেরা। কয়রা উপজেলার সুন্দরবন বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন সূত্র জানায়, সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক নদী-খাল রয়েছে। কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের অধীন সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরার জন্য ৯৪২ জন জেলের অনুমোদন রয়েছে। এদের মধ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৭৫ জন জেলে বনে প্রবেশের পাশ পারমিট সংগ্রহ করেছেন। পাশ পারমিটপ্রাপ্ত জেলেদের মধ্যে ৪৫০ জন মাছ ও ২২৫ জন জেলে কাঁকড়া সংগ্রহের জন্য পাশ নিয়েছেন। বৈধভাবে এক একটি পাশ পারমিটের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দুই জন জেলে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যেতে পারবেন। সংখ্যানুপাতে এক একটি নদী-খালে ছয় জন করে জেলের মাছ ধরার অনুমতি রয়েছে। সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের জন্য সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য একজন জেলের প্রবেশ ফি ১৫ টাকা ও কাঁকড়া ধরার জন্য প্রবেশ ফি ১২ টাকা। এর ওপর রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এছাড়া প্রতি কেজি ইলিশ ও ভেটকি মাছ ধরার জন্য ২৪ টাকা, বাগদা ও গলদা চিংড়ি ৫০ টাকা, সাদা মাছ ৬ টাকা ৪০ পয়সা ও গুঁড়া চিংড়ি ৫ টাকা করে দিতে হয়। কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের নজরুল সানা, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ী গ্রামের জেলে লুত্ফর মোল্লা, মোবারক গাজী ও সালাম সরদার বলেন, আগে একেক জন জেলে সুন্দরবন বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের অধীনের পাশ পারমিট নিয়ে সারা রেঞ্জের সবগুলো নদী-খালে মাছ ধরতে পারতেন। আবার মাছ ধরার জন্য সময় দেওয়া হতো ১৫ দিন। কিন্তু চলতি মৌসুম থেকে জেলেরা একটির বেশি নদী বা খালে মাছ ধরতে পারবেন না। তারা বলেন, আগে জেলেরা একেক বার ১৫-২০ কেজি করে মাছ ধরতে পারত। এখন ৪-৫ কেজির বেশি মাছ পাওয়া যায় না। আবার মাছ ধরার সময় কমিয়ে এক সপ্তাহ করা হয়েছে। এতে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস মাছের ভরা মৌসুম। সেই সময় সুন্দরবনের নদনদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার অভয়ারণ্য এলাকায় মাছ ধরা যায় না। এমনিতেই তিন মাস বেকার থাকতে হয়। তার ওপর একটি খালে দুই-তিন কেজির বেশি মাছ পাওয়া যায় না। রফিকুল নামে একজন জেলে বলেন, ‘গাঙে আগে বড় বড় মাছ ছিল। এখন সে ধরনের মাছ আর নেই। ফলে আমরা জেলেরা অশান্তিতে আছি।’ গনি মিয়া নামে আরেক জন জেলে বলেন, ‘মাছ থাকবে কি করে? খাটা পাটা, বেহেন্দি আর নেট জালে পড়ে ছোট ছোট পোনা সব মরে যায়। ফলে মাছ আর বড় হতি পারে না।’ কয়রা সদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. লুত্ফর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবন বন বিভাগের নতুন সিস্টেমে জেলেদের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। আগে জেলেরা দুবেলা ভাত খেতে পারত, এখন তাও আর জুটবে না।’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের বন কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় বলেন, সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্যই বন বিভাগের পক্ষ থেকে মাছ ধরার ওপর একটু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তবে এতে জেলেদের খুব একটা ক্ষতি হবে না।