গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা আর মানবাধিকারসহ কয়েকটি ইস্যুতে সম্প্রতি ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। এমনকি এ নিয়ে র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো সংকট নেই। শুধু তাই নয়, ফের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো অবস্থাও তৈরি হয়নি। তেমন পরিস্থিতিও দেখা যাচ্ছে না। তবু যেসব বিষয়ে বাংলাদেশে ঘাটতির কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে, সেগুলো ঠিক করা দরকার। পাশাপাশি কোনো নিষেধাজ্ঞা যাতে না আসে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কেননা দেশের ওপর নেতিবাচক (নিষেধাজ্ঞা) কিছু যেন না ঘটে, সেটাই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কারণ, কোনো একটা সমস্যা তৈরি হয়ে গেলে তা আরও ১০ জায়গায় জটিলতা তৈরি করে। তাই সমস্যা তৈরির আগেই তা থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ওপর ফের মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনা প্রসঙ্গে সোমবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেছেন। তারা জানান, নিষেধাজ্ঞা বলে-কয়ে দেয় না। তাই জনগণের স্বার্থে এ বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলছে। রোববার এ নিয়ে সচিবালয়ে কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র আর নিষেধাজ্ঞা দেবে না। বরং তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সহায়তা করবে। আর তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খুব একটা লাভ হয় না। এ সময় তিনি কয়েকটি দেশের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। এ নিয়ে সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আশা প্রকাশ করে বলেন, আমেরিকার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা এসব (নিষেধাজ্ঞা) দেবে না।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, নেতিবাচক কিছু যেন না ঘটে, সেটাই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আমরা এমন কোনো ঝুঁকিতে যাবই না, যে কারণে নেতিবাচক কিছু আসার শঙ্কা তৈরি হবে। সমস্যা তৈরির আগেই তা থেকে দূরে থাকতে হবে। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কোনো একটা সমস্যা তৈরি হয়ে গেলে তা আরও ১০ জায়গায় সমস্যা তৈরি করে। ২০১৩ সালে আমাদের জিএসপি সুবিধা ‘সাসপেন্ড’ (স্থগিত) হয়ে যায়। আজ ১০ বছর হয়ে গেছে, তা ফেরত পাইনি। অবশ্য জিএসপি এখন নেই। কিন্তু না থাকলেও যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তো এখনো তোলা হয়নি। পরে আবার স্যাংশন এলো। এ বিষয়গুলো আমাদের জন্য একটা শিক্ষা দেওয়া যে, যে কাজগুলো সঠিক, সেগুলো আমরা করব। পাশাপাশি এ ধরনের সমস্যা যাতে তৈরি না হয়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখব।
তিনি বলেন, বহুমাত্রিকভাবে আমরা বিশ্বের সঙ্গে ক্রমাগত সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছি। সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি চলছে। যদি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে হয়, টেকসই করতে হয় এবং সাধারণ মানুষের জন্য যদি উপাদেয় করতে হয়; তাহলে আমাদের সহযোগী যারা আছে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। অন্যথায় যদি আমরা কোনো নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে পড়ি, তাহলে আমাদের গতিটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাষ্ট্রদূত কবির বলেন, কাজেই যে কাজটা সঠিক, ব্যাখ্যা ছাড়া সেটা আমাদের (বাংলাদেশের জনগণ) জন্য যেমন সঠিক, তেমনই তাদের জন্যও সঠিক। কাজেই এক বা দুই কিংবা তিন পক্ষের সুবিধার কথা চিন্তা না করে, যেটা করলে মানুষের কল্যাণ হবে, মানুষ উপকৃত হবে, সেখানে থাকলে-এ ধরনের নেতিবাচক বিষয় নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকবে না।
‘খোদ মার্কিন সমাজেও তো মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান ঘটনার কথা বলা হচ্ছে’-এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে বেআইনি কাজ হয় না। কিন্তু বেআইনি কাজ হলে এবং তার যথাযোগ্য বিচারের ব্যবস্থা থাকলে সমাজে ন্যায়বিচার বলে যে ধারণা আছে, সেটা মানুষ পায়। কাজেই কোন দেশে খারাপ হয়, সেটার সঙ্গে আমার তুলনা করা যাবে না। সেটা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে হয় না। আমেরিকায় অপকর্ম হয়, সেটার বিচারও তারা করে। যারা অপরাধ করে, তারা শাস্তি পায়। তাই সেটার সঙ্গে তুলনা করার দরকার নেই। বরং সেই ধরনের কাজ যেন আমার এখানে না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর থাকাই যুক্তিসংগত বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, খারাপ দৃষ্টান্তকে মানদণ্ড হিসাবে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ অনেক অসাধ্য অর্জন করেছে। সেই ইতিবাচক অর্জনের ধারাকে যেন অব্যাহত রাখতে পারি। অন্যরা বাংলাদেশকে দেখে শিখুক। আমরা অন্যকে দেখে বা অন্যের কাছ থেকে খারাপ কিছু শিখতে চাই না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে ‘স্যাংশন’ (নিষেধাজ্ঞা) দেবে। কেননা বাংলায় কথা আছে যে, গুজবে কান দেবেন না। তবে এটা ঠিক যে, এই স্যাংশনের বিষয়টি যত থাকবে, বাংলাদেশ তত অন্য দেশের দিকে চলে যাবে। তাই আমি মনে করি না, এ ধরনের স্যাংশনের কথার কোনো ভিত্তি আছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমন কিছু হয়নি যে নিষেধাজ্ঞা আসবে। এমন কথা কেন মাথায় আসে, আমার বুঝে আসে না। তাহলে তো বহু আগেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত ছিল। আবার মিয়ানমারে যে ‘টোকেন’ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে কিছুই হয়নি। কেননা যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের কোনো ব্যাংক-ব্যালেন্স নেই। তারা বিদেশেও যায় না। আমেরিকায়ও যায় না। তাই তাদের কিছু হয়নি। আসলে এ ধরনের কথাবার্তা যারা বলেন, তাদের নিশ্চয়ই অন্য কোনো বিষয় আছে। কাজেই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেই তো বেশি বাংলাদেশ থেকে লাভ করে। তারা কি এ লাভ নষ্ট করতে চাচ্ছে। যদি চায়, তাহলে বাংলাদেশ আর কী করবে।
তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ যেসব বিষয় টানা হচ্ছে, সেসব ঠিক করা দরকার। কেননা ঘাটতি তো আছেই। এই ঘাটতি বাংলাদেশের জনগণকেই ঠিক করতে হবে। এটা প্রয়োজন। বাইরের শক্তি এসে ঠিক করার অবস্থা কখনোই ছিল না। কিন্তু র্যাবের ইস্যুতে যে নিষেধাজ্ঞার কথা এসেছে, সেটা অন্য কোনো দেশ বললে যথাযথ হতো-যেসব দেশে এমন ‘কিলিং’ নেই। এ বিষয়ে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়াটা অস্বাভাবিক। কেননা নিজের দেশেই এ ধরনের বিষয় আছে। তাছাড়া মানবাধিকারের বিষয় থাকলে তারা ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধান করছে না কেন। তাই বোঝা যায়, অন্য কিছু আছে।
ড. আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এটা কেবল সরকার-সরকার বা নির্বাচনের সম্পর্ক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে, তাদের ভালো একটা লাভ হয়। বিশেষ করে গার্মেন্ট খাতের কথা উল্লেখ করা যায়। এই লাভ শুধু বাংলাদেশের নয়, তাদেরও। কাজেই রাজনীতির হিসাবে এসব কথা থাকবেই। এগুলো গুরুত্ব দেওয়ার মতো কিছু নয়।
তিনি আরও বলেন, তবে কোনো একটা দেশের ওপর আমাদের নির্ভরতা কমানো উচিত। যারা ব্যবসা করেন, তারা আরও ভালো করে জানবেন যে, ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র কতটা লাভ করে। এখানে মানবিক কোনো ব্যাপার নেই। লাভ হয় বলেই তারা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তাই তারা লাভ থেকে বঞ্চিত হতে চাইবে বলে মনে হয় না। তবু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কোনো একটা বাজার বা আইটেমের পরিবর্তে বহু বাজারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটা তারা ভালো করেই জানেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেতিবাচক কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। তবু, যদি খারাপ কিছু হয়ও, বিকল্প থাকলে তখন কিছু হবে না। আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন-আমরা এখন আর ১৯৭০ সালের অবস্থায় নেই। বাংলাদেশ অনেক বড় পোশাক তৈরির মার্কেট।