বিশেষ প্রতিনিধি: আরিফ খান (জয়)
বৃদ্ধ রেহেলা বেগম টিউবওয়েল চাপছেন; কিন্তু পানি উঠছে না।
ছিয়াত্তর বছর বয়সি রেহেলা বেগম , বয়সের ভারে চলাফেরা করাটাই তার পক্ষে এখন কঠিন। স্বামীকে হারিয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। পরিবারের সদস্য বলতে এক ছেলে, তাও থাকেন প্রবাসে। এ অবস্থায় রান্না বান্না থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হয় নিজেকে। জীবন যুদ্ধে তিনি কখনো দমে যাননি। তবে এবার হার মেনেছেন টিউবওয়েলের পানির কাছে। ১৫ থেকে ১৬ বার টিউবওয়েল চাপার পরেও মিলছে না এক গ্লাস পানি। তাই পানি সংকটের কারণে গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজ হচ্ছে ব্যাহত। প্রচণ্ড গরমে তাই তিনি অধিকাংশ সময় পাশের বাড়ির মিনি তাঁরা টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
গৃহবধূ প্রিয়াংকা খাতুনের বাড়িতেও সপ্তাহ দুয়েক ধরে টিউবওয়েলে উঠছে না পানি। প্রতিবেশীদের পরামর্শে মটর কিনে এনে টিউবওয়েলে সেট করেও মিলছে না পানি। খাওয়া থেকে ওজু, গোসল সব কিছুতেই বেগ পেতে হচ্ছে পানি সংকটের কারণ
পাবনা জেলা সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ফলে এলাকায় পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে। একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত পানির অভাবে বোরো চাষ ব্যাহত হচ্ছে।
এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তারা সুপেয় পানির সংকটের কথা জানান। বিশেষ করে পাবনা সদর উপজেলার, চর আশুতোষ পুর, কোমরপুর, ভাঁড়ারা,সাদুল্লাহপুর, টেবুনিয়া,চরতারাপুর, হেমায়েতপুর,দাপুনিয়া,সুজানগর উপজেলার চর সুজানগর, কাদেয়া,দুলাই,তাঁতিবান্ধা,মানিক হাট,চিনাখরা, এবং আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা ইউনিয়নে বিভিন্ন পাড়ায়, মহলায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
লক্ষীপুর
ইউনিয়নের যাত্রাপুর,চকরানী গ্রাম, লক্ষীপুর চরপাড়া,চান্দায়সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট।
দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা। তাই যেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এলাকার গৃহবধূ ও শিশুরা জগ, কলসি ও ঘড়া নিয়ে টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, জেলার সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ২৫০-৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হস্তচালিত অনেক টিউবওয়েল।
জেলায় গভীর-অগভীর মিলিয়ে ১১হাজার ৯১৩টি নলকূপ আছে। এর মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ২ হাজার ২৩৯টি নলকূপ।
পাবনা উপজেলার চর আশুতোষ পুর গ্রামের পল্লি চিকিৎসক মো: রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি ১০বছর ধরে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা দিয়ে বেড়াই। আজ ১০ দিন ধরে আমার বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না। রোদের মধ্যে সারাদিন গ্রাম গ্রাম ঘুরে বাড়ি এসে যদি পানি না পাই তাহলে কেমন লাগে? আমি তাই পাশের মাদ্রাসায় নলকূপে গিয়ে গোসল সেরে আসি। আর গিন্নি বাড়িতে খুব কষ্ট করে পানি তুলে নিজেও বাচ্চাকাচ্চার গোসল সংসারের রান্নাবান্না ও গরু ছাগলের খাওয়ানো সহ সকল কাজ খুব কষ্ট করে করছে। বর্ষা শুরু হলে হয়তো এর সমাধান হবে।’
একই এলাকার দিনমজুর গোলাপ বলেন, ‘সারাদিন মাঠে কাজ করি। বাড়িতে দুটি গরুও পালন করি। গরু দুটির আজ কয়দিন গা ধুয়াতে পারিনি। আবার মাঠে এক বিঘা ধানের আবাদ আছে, তাতে সেচ দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হচ্ছে। যেখানে দুই ঘন্টা মেশিনে পানি দিলে হয়ে যেতো। সেখানে এখন চারটা ঘণ্টা পানি দিয়েও হচ্ছে না।’
পাবনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন ধরেই পাবনাসহ এ উত্তরবঙ্গের ওপর দিয়ে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এখানে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পাবনা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম বলেন, সুপেয় পানির সমস্যা নিরূপণে যেসব এলাকায় সংকট দেখা দিয়েছে।সেই সব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। তবে অতিবৃষ্টি ও পানির অপচয় রোধ করা না গেলে পানি সংকটের সমাধান মিলবে না।