চট্টগ্রামের উপকূল এখনও অরক্ষিত
মাসুদ পারভেজ
চট্টগ্রামের উপকূল এখনও অরক্ষিত আনোয়ারা বেড়িবাঁধ।
চট্টগ্রাম: ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রলয়ংকরী এই তাণ্ডবের ৩১ বছর পরও উপকূলীয় এলাকাগুলোর অনেক স্থানে স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি।
অরক্ষিত উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের খবর শুনলে এখনও নির্ঘুম রাত পার করেন।
ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড আনোয়ারা উপকূলীয় অঞ্চলে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় সেই রাতে।
রায়পুর, জুঁইদন্ডী, বরুমচড়া, বারশত, বারখাইন, হাইলধর, পীরখাইন,টিশরিঘাট, মামরখাইন সহ পুরো উপজেলা বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। উপকূলবাসীকে রক্ষায় মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি’র প্রচেষ্টায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২০১৮ সালে ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
এটি বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরবর্তীতে আরও ১ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেই কাজ এখনও চলমান।
উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের বাইন্নার দীঘি, ফকির হাট, ঘাটকূল, বার আউলিয়া, উত্তর গহিরা, দক্ষিণ গহিরা, মধ্যম গহিরা, পরুয়াপাড়া, ফুলতলী এলাকাসহ উপকূল জুড়ে চলছে বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ। রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন শরীফ জানান, উপকূল রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ চলছে। গত ৩ বছরে এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকতে পারেনি।
২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ৯টি ইউনিয়ন। প্রায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ সম্পন্ন ও ৩০-৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে উপকূল পরিণত হয়েছিল বিরাণভূমিতে। এসময় মারা গিয়েছিল এলাকার প্রায় সাত হাজার মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় তিন হাজার শিশু-নারী-পুরুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় তিনশ কোটি টাকার সম্পদ। বর্তমানে এসব এলাকার বেড়িবাঁধের বেহাল অবস্থা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এখানে যে বেড়িবাঁধ আছে সেটি ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সংস্কার প্রয়োজন। ১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘোড়ামরা-কুমিরাসহ ৪ কিলোমিটার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা থাকায় সংস্কারও হচ্ছে না। নিয়মিত সাগরের পানি ঢুকছে। জনবসতি ও শিপইয়ার্ড নির্মাণে উজাড় হয়েছে বনাঞ্চল। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সীতাকুণ্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জুলফিকার তারেক বলেন, বরাদ্দ সাপেক্ষে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ করা হবে।
বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। প্রাণহানি ঘটে অসংখ্য গবাদিপশুর। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধটি। ২০১৫ সালে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয়। ছনুয়া ছাড়া অন্যান্য এলাকায় কাজ বাঁধ নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। অপরদিকে খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া ও কদমরসুল এলাকায় নতুন করে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।
খানখানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, জোয়ারের পানি ঠেকাতে খানখানাবাদের ঈশ্বর বাবুর হাট থেকে খানখানাবাদ পর্যন্ত রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খানখানাবাদের কদমরসুল, প্রেমাশিয়া, মৌলভীপাড়া এলাকার বাঁধ এখনও অরক্ষিত। কদমরসুল এলাকায় ঝাউ বাগানের ফলে বাঁধ রক্ষা হলেও পূর্ণিমা অমাবস্যার জোয়ারে অনেক সময় পানি প্রবেশ করে। তাছাড়া যেসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তার বেশ কিছু এলাকায় ব্লক ধসে গেছে।
ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম.হারুনুর রশিদ বলেন, ইউনিয়নের ২৭ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৩ কিলোমিটার ব্লক বসানো হয়েছে। ছনুয়ার টেক, সেলবন, মধুখালী, মৌলভী পাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে।
মীরসরাইয়ে ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধকে নতুন প্রকল্পের আওতায় স্থায়ী বেড়িবাঁধে রূপ দেওয়া হচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, রাতের আঁধারে বেড়িবাঁধের মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। বিভিন্ন ইটভাটা ও জায়গা ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এ মাটি।
দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে ঘণ্টায় ২২০-২৪০ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস আর প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে এদিন রাত ১২টার দিকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হয়েছিল ১ লাখের বেশি মানুষ। ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে ১০ কিলোমিটার ব্লক বেড়িবাঁধের কাজ হয়েছে। কালাপানিয়া, হরিশপুর, রহমতপুর, আজিমপুর, মুছাপুর, মাইটভাংগা, সারিকাইত, মগধরা ইউনিয়নের কিছু অংশের পুরাতন বেড়িবাঁধ টেকসই করতে নির্মিত হয়েছে ব্লক বেড়িবাঁধ।
সন্দ্বীপ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পোল্ডার-৭২ এর আওতায় ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার ব্লক বেড়িবাঁধ ও এক দশমিক ১২ কিলোমিটার মাটি ভরাটের কাজ হয়েছে। এছাড়া কালাপানিয়া ইউনিয়ন থেকে পশ্চিম দিক হয়ে দক্ষিণ দিকে ছোয়াখালী থেকে আরও দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে ১৭ দশমিক ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ বাকি রয়েছে।