আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস
মোমিনুল ইসলাম মোমিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
রমজানুল মোবারকের আজ সতের তারিখ। রমজান মাসের আজকের দিনটি অসাধারণ তাৎপর্যের অধিকারী। আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি দ্বিতীয় সনের সতেরই রমজান মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ব ও তার পাঠানো রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মুষ্টিমেয় দলের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াই। তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে প্রায় উপকরণহীন মুষ্টিমেয় দলটিকে জয়ী করেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। তাই শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এ দিনটি অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে।
মদিনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি নিয়ে নাজিল হলো কুরআন মাজিদের কয়েকটি আয়াত। অনুমতি লাভের পর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রস্তুত হলেন। কুরাইশ কাফেরদের সাথে আল্লাহর নবী ও তার সাথীদের কয়েকটি ছোটখাটো সংঘর্ষের পর প্রথম সরাসরি সশস্ত্র মোকাবেলা হয় মদিনা থেকে বেশ দূরে বদর প্রান্তরে। কিন্তু দুই পক্ষে কোনো দিক দিয়েই সমতা ছিল না। আল্লাহর নবীর সাথে মাত্র তিন শ’ তেরজন মুজাহিদ। তারা প্রায় নিরস্ত্র। অপরপক্ষে আবু জেহেলের নেতৃত্বে রয়েছে এক হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী।
লড়াই শুরুর আগে আল্লাহর নবী দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ, তুমি যদি চাও দুনিয়াতে তোমার ইবাদত করার কেউ না থাকুক, তাহলে এই ক্ষুদ্র দলটিকে নিশ্চিহ্ন হতে দাও। আল্লাহ তা চাননি। আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় ছিল বাহ্যিক ও উপকরণগত শক্তির অসারতা প্রমাণ করা। তাই প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুজাহিদের কাছে পরাজিত হয় সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী। কুরাইশদের দর্প চুর্ণ হলো। তাদের পক্ষে নিহত হলো সত্তরজন। বন্দী হয় আরো সত্তরজন। আর মুসলমানদের মধ্যে শহীদ হন মাত্র চৌদ্দজন। যুদ্ধের এ ধরনের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ অভাবনীয়। কিন্তু তা ছিল আল্লাহর কুদরতের নমুনা। তিনি স্বল্পসংখ্যক মানুষকে বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী করে দেখিয়ে দিলেন অবিশ্বাসী লোকদের প্রকৃত দুর্বলতা ও অসহায়তা।
বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরে, যখন তোমরা ছিলে অসহায়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১২৩)
আরো ইরশাদ হয়েছে- (হে নবী ) স্মরণ করুন যখন আপনার প্রভু নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদের যে, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। সুতরাং তোমরা মু’মিনদের অবিচলিত রাখো। আমি অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চারিত করে দেবো। অতএব তাদের ঘাড়ের ওপর আঘাত হানো এবং আঘাত হানো তাদের সর্বাঙ্গে। (সূরা আনফাল, আয়াত-১২)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বিজয়ী বেশে মদিনায় ফিরে আসেন, তখন তার এই বিজয় ও সাফল্যে মদিনা ও আশপাশের এলাকায় তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রচুরসংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি আগেই বিজয়ের সংবাদ দিয়ে দু’জন বিশেষ দূত মদিনায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের একজন ছিলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি এসে বিজয়ের সংবাদ শোনাতে থাকেন এবং বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়, আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তা এবং কাফেরদের হত্যা ও গ্রেফতারি তোমাদের জন্য বরকতময় হোক। কুরাইশদের যেসব নেতা ও বীরপুরুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তিনি তাদের একেকজনের নাম ঘোষণা করতে থাকেন এবং ঘরে ঘরে গিয়ে এই সংবাদ শোনাতে থাকেন। শিশুরা সুর করে ও কবিতার মাধ্যমে এ সংবাদ গেয়ে বেড়াতে লাগল। অন্য দিকে মক্কার ঘরে ঘরে শোকের মাতম বয়ে যায় এবং ইসলামের শত্রুদের অন্তরে ভীতিকর প্রভাব পড়ল। মক্কার দুর্বল ও অসহায় মুসলমানরা যারা হিজরত করতে পারেননি, তারা কাফেরদের পরাজয় ও মুসলমানদের বিজয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এবং নিজেদের অন্তরে শক্তি অনুভব করেন।
তাই বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ জিহাদ। বিশ্বসভ্যতার মোড় ঘুরে যায় এ থেকে। বদরের প্রান্তর থেকে ইসলামের বিজয়ধারা সূচিত হয়। তাই প্রতি বছর সতেরই রমজান মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস, নতুনভাবে প্রত্যয় জাগায় খোদায়ি কুদরতের অসীমতার সামনে নিজের সব কামনা বিলীন করে দেয়ার ।